মিসবাহ ইরান মহেশখালী,
মহেশখালী বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলার অন্তর্গত।এটি বাংলাদেশের একমাত্র পাহাড়ি দ্বীপ যা মহেশখালী দ্বীপ নামেও পরিচিত।কক্সবাজারের উত্তর-পশ্চিমে চকরিয়া উপজেলা পেরিয়ে মহেশখালী দ্বীপ।দ্বীপের তিন দিকে বঙ্গোপসাগর, একদিকে কোহেলিয়া নদী।নদীর ওপর বদরখালী সেতু।সেতুটি দ্বীপকে মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে বেঁধেছে।মাতারবাড়ী ইউনিয়নের পূর্ব দিকে কোহেলিয়া নদী, উত্তর দিকে উজানটিয়া নদী এবং দক্ষিণ ও পশ্চিম দিকে রয়েছে বঙ্গোপসাগর।এছাড়া ইউনিয়নের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে রাঙ্গাখালী খাল।প্রধান যোগাযোগের মাধ্যম ট্যাক্সি বা রিকশা।এছাড়া নৌপথে এ ইউনিয়নে যাতায়াতের ব্যবস্থা রয়েছে।কিন্তু কোহেলিয়া নদী ভরাট হয়ে যাওয়া যাতায়াত দিন দিন কমে যাচ্ছে।
কক্সবাজারের মহেশখালীর মানুষের জীবন-জীবিকার সঙ্গে যেন মিশে রয়েছে কোহেলিয়া নদীটি।সেই অনাদিকাল থেকে মহেশখালীর বাণিজ্য ও পণ্য পরিবহনের বেশির ভাগই কোহেলিয়া দিয়েই হয়ে আসছে।
জেলার অন্যতম নদীর মধ্যে কোহেলিয়া একটি।যুগ যুগ ধরে জোয়ার ভাটায় আপন গতিতে ভরা যৌবনে প্রবাহিত হতো কোহেলিয়া নদীর স্রোত।কালক্রমে তা এখন হারিয়ে যেতে বসেছে।মহেশখালীর কালারমারছড়া ও মাতারবাড়ী-ধলঘাটার মাঝখানে অবস্থিত কোহেলিয়া নদী।সম্প্রতি সময়ে মহেশখালীর ঐতিহ্যবাহী পুরনো এই কোহেলিয়া নদী বাংলাদেশের মানচিত্র থেকে বিলুপ্ত হওয়ার পথে।সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পের সুযোগে এই নদী হত্যাযজ্ঞ শুরু করেছেন ঠিকাদাররা।এতে একসময় নদীতে চলাচল করা কয়েক হাজার মণের লবণের বোট ও যাত্রী চলাচল করলেও এখন সাধারণ নৌযান চলাচলই কঠিন হয়ে যাচ্ছে।বর্জ্য ও পলিমাটি দিয়ে কোহেলিয়া নদী ভরাট করে উন্নয়ন কাজে যাতায়াতের জন্য তৈরি করা হচ্ছে সড়ক। আর এতে স্থানীয় প্রশাসনের বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই।
মাতারবাড়ীতে দেশের সর্ববৃহৎ কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের জন্য ১৪১৪ একর জায়গা অধিগ্রহণ করে বর্তমানে সেখানে মাটি ভরাট করে প্রকল্পের অবকাঠামোগত উন্নয়ন কাজ চলছে দ্রুতগতিতে।আর সে সব প্রকল্পের বিভিন্ন বর্জ্য ও পলি মাটিগুলো পাইপের মাধ্যমে সরাসরি কোহেলিয়া নদীর ওপর ফেলায় দিন দিন ভরাট হচ্ছে।অপরদিকে কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পে যাতায়াতের জন্য নদী ভরাট করে মাতারবাড়ী সেতু থেকে দক্ষিণে প্রায় ৩শ’ ফুট প্রস্থ বিশাল সড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে।
সাড়ে ১৩ কিলোমিটার লম্বা এই সড়কটি ব্যবহার হবে শুধুমাত্র কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রে যাতায়াতের জন্য। সড়কের জন্য ব্যয় হচ্ছে আনুমানিক সাড়ে ৬শ’ কোটি টাকা।এই সকড়টি নির্মাণে কাজ করছে মীর আকতার হোসেন কনস্ট্রাকশন লি. নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন, যেকোনো কারণে কোহেলিয়া নদী মারা গেলে এখানকার শত শত জেলে এবং লবণচাষী ও ব্যবসায়ীর জীবন হুমকির মুখে পড়বে।পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখেপড়বে।পরিবেশকর্মী আরো বলেন কোহেলিয়া নদীর আশেপাশে চলমান অপরিকল্পিত ভরাট ও দখল প্রক্রিয়া অবিলম্বে বন্ধ করাসহ নদীর সীমানা নির্ধারণ করে তা উদ্ধার করা উচিত।সাড়ে সাত কিলোমিটারের সড়কটির অন্তত ৫ কিলোমিটার পড়েছে নদীর তীরের অংশে। ৮০ ফুট প্রস্থের সড়কটি নির্মাণের জন্য নদীর তীরের কোথাও ৩০ ফুট, কোথাও আবার ৫০ ফুট করে ভরাট করা হয়েছে।
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনসহ (বাপা) কক্সবাজারের আরও কয়েকটি পরিবেশবাদী সংগঠনের সদস্যরা এসেছিলেন।প্রকাশ্যে নদী ভরাটের দৃশ্য দেখে তারা মর্মাহত হয়েছেন।জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সদস্য শারমিন মুর্শেদ জানান, মাতারবাড়ীতে কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের নাম দিয়ে কিছু অসাধু কোহেলিয়া নদী ভরাট করে সড়ক নির্মাণ করছে। যার কারণে নদী ছোট হয়ে গেছে আর তাতে মাছ নেই। পৃথিবীর কোনো দেশ এভাবে নদী দখল করে উন্নয়ন হচ্ছে না।
বাপার সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল জানান, যেকোনো কারণে কোহেলিয়া নদী মারা গেলে এখানকার শত শত জেলে এবং লবণচাষি ও ব্যবসায়ীর জীবন হুমকির মুখে পড়বে। কাজেই প্রকৃতি এবং পরিবেশ বিপর্যয়ের সম্ভাবনা রয়েছে।
স্হানীয় ব্যবসায়ীরা বলছেন, মহেশখালীর লবণ, মাছ, শুঁটকি এই নদী দিয়ে কার্গো বোঝাই করে নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরবরাহ হতো। এখন তা-ও বন্ধ। নদীর দুই তীরে অন্তত ১ হাজার একর জমিতে উৎপাদিত হচ্ছে লাখ লাখ মণ লবণ। এ লবণ ভিন্ন পথে পরিবহনের ক্ষেত্রে চাষিদের অতিরিক্ত খরচ হচ্ছে প্রতি মণে ২০ থেকে ২৫ টাকা।
জাপানের উন্নয়ন সংস্থা জাইকার প্রায় ৩২০ কোটি টাকা ব্যয়ে সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের তত্ত্বাবধানে সড়ক নির্মাণ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মীর আক্তার কোম্পানি। প্রতিষ্ঠানের প্রকল্প ব্যবস্থাপক সাইদুর রহমান বলেন, সব দেখেশুনে প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছে। নকশা অনুযায়ীই তাঁরা কাজ করছেন।
কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী প্রবীর কুমার গোস্বামী বলেন, কোহেলিয়া নদীসহ কক্সবাজারের সকল নদী নিয়ে আমাদের বিশাল পরিকল্পনা রয়েছে। এ বিষয়ে আমাদের একটা মিটিং রয়েছে, এরপরেই বিস্তারিত বলবেন।
প্রকল্প এলাকায় যাতায়াতের জন্য নদী ভরাট করে মাতারবাড়ী সেতু থেকে দক্ষিণে প্রায় ৩০০ ফুট প্রস্থ বিশাল সড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে। এই সকড়টি নির্মাণের দায়িত্বে পায় মীর আকতার হোসেন কনস্ট্রাকশন লিমিটেড নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।এতে দিন দিন ছোট হয়ে যাচ্ছে কোহেলিয়া।ফলে নদীতে চলাচলকারী ইঞ্জিনচালিত লবণের বোট ও বিভিন্ন ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়ে গেছে।কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের পলি মাটি নদীর পানির সঙ্গে মিশে পানি ঘোলাটে হয়েছে। দূষিত হওয়ায় নদীর দুই পাশে প্রায় অর্ধশত চিংড়ি মাছের প্রজেক্টে মাছ মারা যাচ্ছে। এ কারণে লোকসান গুনতে হচ্ছে শতকোটি টাকার চিংড়ি প্রজেক্টের ইজারাদারদের।